বিশ্ববিখ্যাত সিরিজগুলো নিয়ে আলোচনা করলে সবার প্রথম সারিতে যে কয়েকটা নাম আসে তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো প্রিজন ব্রেক। যারা নিয়মিত হলিউড সিরিজ দেখে তারা এই সিরিজ দেখেনি এরকম সিরিজখোর খুব কমই বা আদৌও পাওয়া যাবে কি-না বলা মুশকিল। প্রথম সিজন রিলিজ পেয়েছিল ২০০৫ সালে, তো বুঝতেই পারছেন কত আগের সিরিজ। তারপর দর্শকদের ব্যপক সাড়ার ফলে ধাপে ধাপে সিরিজটি সামনের দিকে আগাতে শুরু করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ২০১৭ সালে। প্রায় দীর্ঘ ১২ বছরের বিশাল এক পথযাত্রা।
পরিচালনার বিষয়ে বলতে গেলে Paul T. Scheuring একজন খুবই সুপ্রসিদ্ধ এবং গুণী পরিচালক। প্রিজন ব্রেকের মতো বিখ্যাত সিরিজ ছাড়াও তার লিস্টে রয়েছে আরও অসংখ্য নামি-দামি মুভির নাম। যার মধ্যে আমার উল্লেখযোগ্য- The Experiment, The Experiment, Halo: Nightfall
সিরিজঃ প্রিজন ব্রেক
ইন্ডাস্ট্রিঃ হলিউড
ভাষাঃ ইংলিশ
দেশঃ ইউএসএ
মোট সিজনঃ ০৫
রানটাইমঃ ৪৪ মিনিট গড়ে
রিলিজ সালঃ (২০০৫ – ২০১৭)
আইএমডিবি রেটিংঃ ৮.৩/১০
পার্সোনাল রেটিংঃ ৮.৫/১০
ক্রিয়েটরঃ পাল টি শিওরিং
কাস্টঃ ডমিনিক পুরসেল, ওয়ান্টওয়ার্থ মিলার, রবার্ট ন্নিপার, সারা ওয়েইন ক্যালিজ
জনরাঃ অ্যাকশন, ক্রাইম, ড্রামা
এরকম দীর্ঘ সিরিজগুলোতে যা হয়, আপনার মনে সেখানকার লিড রোলগুলোর প্রতি আলাদা একটা মায়া জন্মে যাবে, কখনো-বা তাদের প্রেমেও পড়ে যাবেন। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটার প্রশ্নই আসে না। মাইকেল স্কোফিল্ড চরিত্রে ওয়েন্টওর্থ মিলার যা অভিনয় দেখিয়েছে তার প্রশংসার ফুলঝুরি এখনও সবার মুখে মুখে। তাইতো কিছুদিন পর পর রিউমার শুনতে পাওয়া যায়, এই বুঝি প্রিজন ব্রেক আবারও যাত্রা শুরু করলো। যদিও এবারের রিউমার বেশ জমজমাট এবং হট টপিকে ছিল। পরিচালকসহ অনেকেই অফিশিয়ালি আগমন জানানোর বার্তা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, দর্শকদের বিদ্রুপ মন্তব্যে পার্সোনালি আঘাতের শিকার হয়ে প্রিজন ব্রেক থেকে সরে দাঁড়ানোর সংবাদ অফিশিয়ালি জানিয়ে দিয়েছেন। তার মানে খুব স্পষ্ট যে, প্রিজন ব্রেক অফিশিয়ালি এন্ডিং হয়ে গেল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মুভির চেয়ে সিরিজ দেখা পছন্দ করি অধিক। কারণ বিশিষ্ট সিরিজগুলোতে যে আলাদা একটা স্টাইল, জীবনযাত্রা আছে তা মুভিতে সেভাবে উঠিয়ে তোলা হয় না। কারণ সিরিজে হাতে সময় থাকে পর্যাপ্ত। তাই কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো সুন্দর করে আগাগোড়া ফুটিয়ে তুলতে কোনো অসুবিধা হয় না। তেমনি একজনের কথা উল্লেকজ করতে যাচ্ছি, অবশ্য তার সম্পর্কে যত বেশি বলব, ততই কম মনে হবে। “ওয়েন্টওর্থ মিলার” যদিও বেশিরভাগ ভক্তবৃন্দ তাকে মাইকেল স্কোফিল্ড নামেই চিনে, এবং ব্যক্তিগত ফিল্ডেও মাইকেল স্কোফিল্ড নামেই সুপরিচিত। কারণ সিরিজের মূল এই চরিত্রটা সে যতটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে তা হয়তো অন্যকাউকে দিয়ে সম্ভব হতো না। তাইতো শত হিমশিম থাকা স্বত্বেও দর্শকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার জুটিবদ্ধ হয়েছেন। টেনেছেন এক সিরিজকেই প্রায় ১২ বছর, যা মোটেও কম কথা না। তাছাড়া আরও একজন রয়েছে যার সাথে স্কোফিল্ডের সম্পর্কটা বাস্তব জীবনেও বেশ সুপ্রসিদ্ধ হয়েছিল। সিরিজে তাদের সম্পর্কটা আপন ভাই হিসেবে ছিল, আমাদের দেখা সাধারণ ভাই সম্পর্কের না। তাদের সম্পর্কটা এতটাই গভীর ছিল যে এক ভাইয়ের বিপদে অন্য ভাই তার সম্পূর্ণ জীবন একেবারে নির্দ্বিধায় বাজি রেখে দিয়েছিলেন। “ডুমিনিক পোর্সেল” অভিনয় করেছেন মাইকেল স্কোফিল্ড এর বড় ভাই হিসেবে লিংকন বোরোস নামক চরিত্রে। এতবড় একটা সিরিজে একটা সংক্ষিপ্তসার নায়িকা না থাকলে কি হয়? বলছি ভালো লাগার একজনের কথা, যাকে প্রথম দেখায় খুব একটা ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে তার সুনিপুণ অভিনয় আর গ্ল্যামারে ভালো লাগাতে বাধ্য করে। এমনকি একটা পর্যায়ে তার অপেক্ষায় স্ক্রিনটাইমে বসেও থাকতাম, কখন দেখা মিলবে তার। সারহে জুড়ে দেয়া হয়েছে সুন্দর পরিপাটি একটা নাম “সারাহ”, যদিও সিরিজের তার নামটা তার রিয়েল নাম থেকেই আনা হয়েছিল। এদের পার্সোনাল প্রজেক্ট নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি না, কারণ এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি এই সিরিজ দেখলে আপনি এম্নিতেই তাদের ফ্যান হয়ে যাবেন।
কাহিনির সূত্রপাত এক কয়েদীকে ঘিরে, যাকে রাজনৈতিক এবং পারিপার্শ্বিক কিছু অজানা কারণে জেলে ঢুকানো হয়। তাদের অবস্থান থেকে সেই কয়েদি সম্পূর্ণ নিরপরাধ, তাই তাদের জন্য এসব মেনে নেয়াটা কষ্টসাধ্য ব্যপার। আর তার উপর যদি আবার যুক্ত হয়, যে কয়েদীকে ফাঁসির রায় শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। এবং পাঠানো হয়েছে দেশসেরা এক কারাগারে, যেখান থেকে পালানোর চিন্তা করাটাই যেন দুঃসাধ্য বিষয়। এরকম পরিস্থিতিতে যখন কয়েদি লিংকন বোরোস নিজের মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন, ঠিক তখনই আবির্ভাব ঘটে তার প্রাণপ্রিয় ভাই মাইকেল স্কোফিল্ড। যে কি-না পেশায় আবার একজন বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার। যার পৃথিবীতে একজন প্রকৃত ভাই আছে, তাকে হারানো দুষ্কর। ঠিক তেমনি মাইকেল স্কোফিল্ড থাকতে লিংকন বোরোসের আর চিন্তা কীসের! পাশে আছে লিংকনের প্রাক্তন প্রেমিকা, যে কি-না পেশায় একজন ছোটখাটো আইনজীবী। কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তার ভাইকে আইনের খোরাক থেকে কীভাবে বের করবে? তা কি আদৌও সম্ভব? সেটা দেখতে হলে আপনাকে ব্যয় করতে হবে মোটামুটি দুই সিজন।
ও হ্যাঁ বলা হয়নি, লিংকন না হয় অপরাধ করেছে তাই সে খুব সহজেই কারাগারে চলে যেতে পেরেছে, কিন্তু মাইকেল? একজন সৎ মানুষ হয়েও কীভাবে কারাগারে যাবে, তাও আবার কাঙ্ক্ষিত কারাগারে! উত্তর জানাটা মাইকেল খুব সহজ করে দিয়েছেন একেবারে প্রথমেই। একেবারে অপ্রয়োজনীয় ভঙ্গিতে, সাধারণভাবে একা একা চলে যায় একটি ব্যাংকে ডাকাতি করতে। সেখানে ঘটে আরেক মজার ঘটনা৷ ডাকাতকে দেখে তারা দেখে ভয় পেয়ে সব দিয়ে তাকে সেখান থেকে পাশ কাটাতে চাচ্ছে, কিন্তু মাইকেলের তো এসব চায় না, তার প্রয়োজন একেবারে পরিকল্পনা মাফিক সুক্ষ্ণভাবে পুলিশের হাতে ধরা খাওয়া।
আর এখান থেকেই শুরু অসাধারণ সব থ্রিলার, মস্ত বড় এই কারাগার ভাঙ্গতে নিঃসন্দেহে অনেক জনবলের প্রয়োজন, আর সেটা কি ঠিকমতো পাবে না-কি থামতে হবে পথে পথে!
আর শেষ অব্ধি কি তারা বের হতে পারবে, আর বের হলেও কতজনকে সাথে নিয়ে পারবে! জানার জন্য নির্দ্বিধায় বসে পড়ুন, দেখেই জানাবেন কেমন লেগেছে।
এরকম মাস্টারক্লাস সিরিজের ক্ষেত্রে একটাই, একেবারে চখম। তবে একটা কথা না বললেই নয়, একটা সিরিজ বা মুভিতে যে প্রয়োজন টানাটানি দরকার ঠিক ততটুকু করাই বেটার, প্রয়োজনে একটু কমানো যায়, কিন্তু বাড়ানোটা অনেকেই নিতে পারে না। যেমনটা এই সিরিজের ক্ষেত্রে হয়েছে, শেষের দিকে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সিজন পর্যন্ত সবাই সন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু পঞ্চম সিজন দেখে অনেকেই বিগড়ে গেছেন, কারণ সেটা আগেরগুলোর মতো প্রত্যাশা মাফিক হয়নি। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছে, এতটা টানাটানি না করে আর একটু ছোট হলেই হয়তো ভালো লাগত। শেষ ধাপে এসে আমি একজনের নাম উল্লেখ করব বিশেষ ধাপে, যার নাম Robert Knepper, অভিনয় করেছেন “টি ব্যাগ” চরিত্রে। একজন হেটার্সকে আপনি যতবেশি ঘৃণা করতে পারবেন ততই তার সেই চরিত্রে অভিনয়ের স্বার্থকতা। আর সেই অসাধারণ গুরু দায়িত্বটা কাধে তুলে নিয়েছেন রবার্ট, যার চরিত্রের অভিনয় আর স্বভাব দেখে কয়েকশ গালি তো দিবেনই, আর সেটাই তার অভিনয়ের স্বার্থকতা, যেমনটা দরকার ছিল ঠিক তেমনটাই উপহার দিয়েছেন আমাদের।
ধন্যবাদ।